মির্জা মাহামুদ রন্টু নড়াইল প্রতিনিধিঃ ৪ বছরের শিশুকে ধর্ষনের মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ধর্ষন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১৬ বছরের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিশোর অপু বিশ্বাস কে। এমনকি মামলার এজাহারে আসামী শিশুটির বয়স ১৯ দেখিয়ে পুলিশ ১৬১ ধারায় জবানবন্দীও নিয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুটি বর্তমানে ধর্ষনের আসামী হয়ে জেলহাজতে দিন কাটাচ্ছে।
পরিবার ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, একটি চক্র ধর্ষনের অভিযোগের ভয় দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে গভীর রাতে কথিত ধর্ষক কে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। মাশরাফি ও নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশনের নাম ভাঙ্গিয়ে এসব করেছে ঐ চক্রটি।
এদিকে ৪ বছরের শিশু ধর্ষনের অভিযোগ তুললেও নড়াইল সদর হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড ধর্ষনের কোন আলামত না পেয়ে প্রতিবেদন পেশ করলেই ক্ষিপ্ত হয় চক্রটি। ধর্ষনের রিপোর্ট পজেটিভ করতে আবাসিক মেডিকেল অফিসারকে চাপ প্রয়োগ করে,না পেরে উল্টো চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে উৎকোচের অভিযোগ তুলে মানববন্ধন করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে চিকিৎসকরাও ১৫ সেপ্টেম্বর সাংবাদিক সম্মেলন করে। গত ২০ দিন ধরে নড়াইলে শিশু ধর্ষনের এই কাহিনী নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হচ্ছে।
৩০ আগষ্ট সকাল ১১ টায় নড়াইল পৌর এলাকার উজিরপুরে ৪ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষন করা হয়েছে এমন অভিযোগে রাত সাড়ে এগারটায় শিশুটিকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে রাত ৯টার দিকে ধর্ষনের ঘটনায় মিমাংশার জন্য শালিশ করার চেষ্টা করে স্থানীয় কয়েকজন। শালিশে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে রাসেল বিল্লাহ ও সাকিব নামে দুই যুবক এমপি মাশরাফির লোক পরিচয়ে আসামী অপু বিশ্বাসকে বাড়ি থেকে ধরে এনে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
এলকাবাসী জানায়, শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে রাসেল বিল্লাহ ও সাবিক রাত একটার দিকে আবারও ঐ দুই জন অপু বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে তাদের পরিবারের সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলে পরিবারের লোকেরা ভয়ে বাইরে আসেনি।
৩০ তারিখে রাত সাড়ে এগারটায় রাসেল বিল্লাহ কয়েকজন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে জরুরী বিভাগের চিকিৎসককে নানা ভয় দেখিয়ে ধর্ষনের আলামত আছে এমন বক্তব্য দিতে বাধ্য করেন। জরুরী বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক ডা.সুব্রত নাগ বলেন, আমি বলেছি ধর্ষনের আলামত থাকতে পারে, তবে এই ব্যাপারে পরীক্ষা না করে আমার পক্ষে বক্তব্য দেয়া সম্ভব নয়।মিডিয়াতে আমার খন্ডিত বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। রাসেল বিল্লাহ আমার আমাকে বক্তব্য দিতে বাধ্য করেছে।
৩১ আগষ্ট শিশুটির ডাক্তারী পরীক্ষায় ধর্ষনের কোন আলামত পায়নি সদর হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড। রাসেল বিল্লাহ এ সময় আবাসিক মেডিকেল অফিসারকে ধর্ষনের পজেটিভ রিপোর্ট করার হুমকী দেয়।
নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা.মশিউর রহমান বাবু বলেন, ধর্ষনের রিপোর্ট করতে গাইনী,প্যাথলজী ও রেডি ৪ টি বিভাগের পরীক্ষা প্রয়োজন হয়, সেই অনুযায়ী শিশুটি ধর্ষনের শিকার করা হয়েছে এমন কোন আলামত পাওয়া যায়নি।
সরেজমিন ১৭ ও ১৯ সেপ্টেম্বর ঘটনা অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায় নানা তথ্য। মামলার ৩ জন স্বাক্ষীর মধ্যে ২ জন প্রতিবেশী একজন শিশু মেয়েটির ফুফু। ১ নং স্বাক্ষী সাগরী(৩০) জানায়, আমি কাতেবর চাচাকে বললাম, আমি কিছু জানিনা আমাকে স্বাক্ষী করেছেন কেন? উনি বললেন,ক্যান তোরা কিছু বলতে পারবি না? তখন আমি বললাম আপনার মেয়ের তো কোথাও কোন কাটা-ছিড়া, ফোলা দেখলাম না তা আমি কি মিথ্যা স্বাক্ষী দেব? উনি আমাকে বললেন,তোদের নাম কেটে দেব।
২ নং স্বাক্ষী রিক্ত(৩২) বলেন, এটি একটি মিথ্যা ঘটনা সাজানো হয়েছে। সারাদিন মেয়েটি সুস্থ্য হয়ে আমাদের সামনে দিয়ে খেলে বেড়ালো অথচ রাতে মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করলো, কি মনে করে তারা ধর্ষনের মামলা দিলো জানিনা। পরদির শুনলাম যে আমাকে স্বাক্ষী করা হয়েছে।
বাড়িতে তালা, কাতেবর মোল্যা ও তার স্ত্রী কে পাও যায়নি, একটু পরে ধর্ষনের শিকার শিশুটিকে সাথে নিয়ে মামলার ৩ নং স্বাক্ষী আনজিরা আসলেন। তিনি বলেন, ঘটনাটি সাজানো নয়, তবে মেয়েটির যে রকম হবার কথা ছিলো সেরকম কিছু হয়নি।
কাতেবর মোল্যার মেজ ভাই শাহাদত মোল্যা বলেন, সারাদিন মেয়েটি খেলে বেড়ালো আর সন্ধ্যায় শুনলাম সে ধর্ষন হয়েছে। আমি ছোটভাই কাতেবর কে বলেছিলাম তুমি ধর্ষনের মামলা করতে যেও না, কিন্ত সে আমার কথা শুনলো না।
মেজ ভাই’র স্ত্রী আখিরোন নেছা বলেন,মেয়েটি সারাদিন আমাদের বাড়িতে খেলেছে। যে ছেলেটির নামে অভিযোগ সে হাবাগোবা ছেলে। সারাদিন ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মোবাইলে গেম খেলে। আমার দেবর এই ছেলেটির নামে মিথ্যা মামলা করেছে। সারাদিন কিছু শুনরাম না রাতে শুনলাম অপুকে ধরে নিয়ে গেছে।
অপু বিশ্বাসের বাড়িতে চলছে হাহাকার, বৃদ্ধা দাদি উঠানে বসে কান্না কাটি করছেন। আমার পাগল নাতিটাকে ওরা জোর করে নিয়ে গেল, সে বাড়িতে ছাড়া খেতে পারেনা। আমি এতকরে বললাম আমার আধপাগলা নাতিটাকে তোমরা নিওনা। তারা নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিলো।
ধর্ষনের আসামী অপু বিশ্বাসের বড়ভাই সজিব বিশ্বাস বলেন, কয়েক বছর আগে আমাদের থেকে ৪ শতক জমি কেনে,কিন্তু সেই জমির টাকা পয়সা শোধ করে না, টাকা চাইলে নানা টালবাহানা করে। এখন আমার ভাইয়ের নামে মিথ্যা ধর্ষন ঘটনা সাজিয়ে আমাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করছে।
অপুর বাবা শিশির বিশ্বাস জানান, আমার ছেলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, এলাকার সবাই তারে পাগল বলে ডাকে। আমার ছেলের বয়স বাড়িয়ে তার কাছ থেকে পুলিশ জবানবন্দী নিয়েছে। আমার ছেলেকে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জড়ানো হয়েছে, আমি এর বিচার চাই।
নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশনের সাধারন সম্পাদক তরিকুল ইসলাম অনিক বলেন, নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন এবং মাশরাফির নাম ভাঙ্গিয়ে যদি কেউ রাত বিরাতে কোন অন্যায় কাজের সাথে যুক্ত হয় তাহলে বিষয়টির অবশ্যই প্রতিবাদ করছি, আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো।
এদিকে এ ঘটনায় মাশরাফির নাম ভাঙ্গিয়ে আসামী আনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ধর্ষন ঘটনায় অনুসন্ধান চালানো স্থানীয় সাংবাদিক কাজী আনিস কে মোবাইলে হুমকী দেয় রাসেল বিল্লাহ।একটি ভিডিও আপলোড করা নিয়ে ঐ সাংবাদিককে তার পেশা নিয়ে কটুক্তি করে ভিডিও আপলোড করায় তিরস্কার করে।
এই ঘটনার নেপথ্যে থাকা রাসেল বিল্লাহ ধর্ষনের রিপোর্ট পজেটিভ করতে চিকিৎসকদের চাপ দেবার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমি শুধু জরুরী মেডিকেল অফিসার এর পজেটিভ রিপোর্ট কিভাবে নেগেটিভ হলো এটাই আর এমও কে জিজ্ঞেস করেছি,রাত ১টায় অপু বিশ্বাসের বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে তার বক্তব্য, সে সহানুভুতি দেখাতে গিয়েছিলো।
খোজ নিয়ে জানা গেছে,কথিত ধর্ষন মামলার আসামী অপু বিশ্বাস একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।স্থানীয় উজিরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেনীর ছাত্র। তার জন্ম ২০০৪ সালের ১০ জুন। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারী সিভিল সার্জন অফিসের চিকিৎসক ডা.অলোক কুমার বাগচী স্বাক্ষরিত প্রতিবন্ধী আবেদনপত্রে তাকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মর্মে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ডা.অলোক কুমার বাগচী বলেন, আমি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই দেখেছি অপু বিশ্বাস একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তাই তাকে ঐ সনদ দেয়া হয়েছে।
কাতেবর মোল্যা’র ভগ্নিপতি আলী হাসান খন্দকার বলেন, আমি আর এলাকার কাউন্সিলন রাজু একটি মিমাংশার কথা বলেছিলাম। এতবড় ঘটনা এটাতো এমনি মাফ করা যায় না। কিন্তু সেটাতে শিশির বিশ্বাস রাজী না হওয়ায় কারনে আমরা মামলা করেছি।
মামলার বাদী কাতেবর মোল্যাকে প্রশ্ন করা হলো, সকালের ঘটনায় মেয়েকে রাতে হাসপাতালে ভর্তি করালেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঐ দিন বিকালে আমি বাড়ি আসার পরে মেয়ের শরীর খারাপ দেখে ঘটনা শুনতে পারি। তবে মিমাংশার উদ্যোগের কথা স্বিকার করেন তিনি জানান,৪ বার আমি শিশির বিশ্বাসকে ডাকতে গেছি,আমার কথা তারা কানেই তোলেনি।
নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইলিয়াছ হোসেন পিপিএম বলেন, এলাকার কিছু লোক আসামীকে ধরে দিয়েছে। আমরা প্রতিবন্ধী জানতে পেরে তার সাথে সেইভাবে ব্যবহার করেছি। আর ১৬১ ধারায় থানায় প্রত্যেকেরই জবাববন্দী নেয়া হয়। বয়স কম প্রসঙ্গে তিনি বলেন,এটা বাদী তার এজাহারে উল্লেখ করেছে পুলিশের চার্জশীট পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।