রুহুল আমীন তালুকদার, সিলেট :
সিলেট, সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকটি উপজেলায় পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা কবলিত। সুরমা, যাদুকাটা, কুশিয়ারা, সারী, ধলাইসহ সকল নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ঝুঁকিতে রয়েছে অনেক হাওরের বাঁধ। অধিক পানির চাপে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বহু বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। বাঁধ ভেঙ্গে একের পর এক হাওর ও ফসলী জমি তলিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি ৫.৯৯ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। বিপদসীমার কাছা কাছি অবস্থায় থাকা এই পানি আরও বৃদ্ধি পেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে এবং আগামী ২৪ ঘন্টা সময়কে সুনামগঞ্জের জন্য বিপজ্জনক বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশারফ হোসেন ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জর কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ পরিদর্শন করেছেন বলে জানা গেছে।
৫ এপ্রিল মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের কৃষকরা জীবন জীবিকার সন্ধিক্ষণে বাঁধ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং স্বেচ্ছাশ্রমে দিনরাত বাঁধ মেরামতে কাজ করে যাচ্ছেন। হাওর অঞ্চলের কৃষকদের দাবী সঠিক সময়ে বাঁধে কাজ শেষ না করা পানির চাপে দুর্বল বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাই বোরো ফসল হানীর শঙ্কায় রয়েছে কৃষকরা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনের পাশাপাশি জনসাধারণকে বাঁধ মেরমতে এগিয়ে আসতে আহবান জানিয়েছে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসন জাহাঙ্গীর আলম।
ঢলের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানির চাপে সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ, দিরাই, ধর্মপাশা, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার অনেকগুলো বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের পাউবোর তুফানখালি বাঁধ, ফাটল দেখা দেওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে বরাম হাওরের বোরো ফসল। তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরের আনন্দনগর বাঁধ দেবে গেছে। এই বাঁধ নতুন করে সংস্কার করছেন পিআইসির লোকজন। শান্তিগঞ্জ উপজেলার শালদিকা, রাঙ্গামাটি, বেদাখালিসহ একাধিক বাঁধে ফাটল দেখা দেয়ায় সোমবার রাতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন সংশ্লিষ্ট গ্রামের চাষীরা। বিশ্বমম্ভরপুর উপজেলার হরিমন ভাঙ্গা ফাটল দেখা দেয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে করচার হাওরের প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল।
এদিকে সারী, গোয়াইন ও পিয়াইন নদীসহ উপরের দিকের পানি কমতে থাকলেও সিলেট জেলার দক্ষিণ এলাকায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ও ভয়াবহ হয়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াকুল ও নন্দিরগাঁও ইউনিয়নে নতুন করে তলিয়ে গেছে আরো কিছু বোরো ফসল। মঙ্গলবার পর্যন্ত উপজেলায় ৯০০ হেক্টর জমির বোরো ফসল বন্যা আছে বলে উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলার কয়েকজন কৃষকরা জানান- সহশ্রাধিক হেক্টর জমির বোরো ধান বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। বন্যার পানি থেকে উদ্ধার হলেও তলিয়ে যাওয়া বোরো ফসল কাজে আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ হিসেবে তারা বলছেন এই যে অবস্থায় ধান তলিয়ে গেছে, ধানে এখনো চাল ধরে নাই এ অবস্থায় উদ্ধার হলেও আর কাজে না আসার সম্ভাবনাই বেশি। গোয়াইনঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রায়হান পারভেজ রনি বলেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার নয় শত হেক্টর বোরো ফসল পানিতে নিমজ্জিত আছে। প্রশাসন সহ আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং এ আছি। বন্যার পানি থেকে উদ্ধার হওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে।
জৈন্তাপুর গত তিন দিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সারী ও বড় নয়াগং, রাংপানি নদীর পানি স্বাভাবিকের বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনবরত বৃষ্টিপাত হলে যেকোন মুহুত্বে সবকয়েটি নদীর পানি বিপদ সীমার উপরদিয়ে প্রবাহিত হবে। সরজমিনে বন্যা কবলিত এলাকা মেঘলী, বন্দরহাটি, লামাপাড়া, ময়নাহাটি, জাঙ্গালহাটি, মজুমদারপাড়া, নয়াবাড়ী, হর্নি, বাইরাখেল, গোয়াবাড়ী, তিলকৈপাড়া, বড়খেল, ফুলবাড়ী, ডিবিরহাওর, ঘিলাতৈল, হেলিরাই, মুক্তাপুর, বিরাইমারা হাওর, লামনীগ্রাম, খারুবিল, চাতলারপাড়, ডুলটিরপাড়, ১নং লক্ষীপুর, ২নং লক্ষীপুর, আমবাড়ী, ঝিঙ্গাবাড়ী, কাঠালবাড়ী, নলজুরী হাওর, বালিদাঁড়া, রামপ্রসাদ, থুবাং, বাউরভাগ উত্তর, বাউরভাগ দক্ষিণ সহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা সর্ব বৃহত সারী নদী ও বড় নয়াগাং নদী এবং রাংপানি নদীর পানি বিপদ সীমার নিকটে চলে আসছে৷ টানা বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে নদীর পানি সমুহ বিপদ সমীর নিকটে চলে আসবে।সারী-গোয়াইন বেড়ীবাঁধ প্রকল্পের কর্মকর্তা মোঃ আলা উদ্দিন বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের কারনে পানি নিম্নাঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যহত থাকলে পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করবে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টানা বর্ষণে ও আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে কয়েকটি হাওরের ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। টানা বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে উপজেলার নিম্নাঞ্চল। বেশকিছু গ্রামের নিচু স্থানের রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে ও বাড়িঘর পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ঝুঁকির মুখে পড়েছে বেশ কয়েকটি ফসল রক্ষা বাঁধ। রবি ও সোমবার ভোরে উজান থেকে আসা অব্যাহত পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর, ইসলামপুর পশ্চিম, তেলিখাল, ইছাকলস, উত্তর রণিখাই ইউনিয়ন ও দক্ষিণ রনিখাই চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার উঠতি আধাপাকা ও কাঁচা বোরো,সরিষা, আলু, বাদাম, শাক সবজির ফসিল জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। আজও কয়েকটি বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেছি। এখনও বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণে আছে, আশাকরি আগামীকাল থেকে পানি কমে যাবে।
এছাড়াও সুনামগঞ্জ জেলার সদর, জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, বিশ্বম্ভরপুর ও জগন্নাথপুর উপজেলার অনেক বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। এসব বাঁধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সাথে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন স্থানীয়রা। সংশ্লিষ্ট উপজেলার মসজিদের মাইকে মাইকিং করে বাঁধ রক্ষায় এগিয়ে আসতে জনগণকে আহবান করা হচ্ছে। জীবন জীবিকার একমাত্র বোরো ফসল ঘরে তুলা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন হাওর অঞ্চলের কৃষকরা।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওর অঞ্চলের কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাঁধ রক্ষা গত ৩ দিন ধরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দিন রাত কাজ করছেন ও পাহারা দিচ্ছেন।
তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর পাড়ের কৃষক ময়না মিয়া বলেন, সময় মতো বাঁেধর কাজ শেষ না হওয়ায় আজ এই অবস্থা। বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি ডুবলে আমরা যাবো কোথায়। ছেলেমেয়ে নিয়ে কি করে বাঁচবো। হাওরের ফসল হানি হলে আমাদের কে দেখবে। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু বাবুল বলেন, নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শুরু ও শেষ না হওয়ায় আজ হাওরের এমন দশা। অনিয়ম দুর্নীতির মানুষের ফসল ঝুঁকিতে রয়েছে। যে ভাবে নদীর পানি বাড়ছে এটি অব্যাহত থাকলে হাওর এলাকায় মানবিক বিপর্জয় দেখা দিবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহীদুল ইসলাম বলেন, পানি বাড়লে পরিস্থিতি কঠিন দিকে যাবে। স্থানীয়ভাবে মসজিদের মাইকে মাইকিং করা হচ্ছে। বাঁধে বস্তা বাঁশ রাখা হয়েছে। বাঁধ রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন স্থানীয়রা। বিশিষ্টজনেরা আগামী ২৪ ঘন্টাকে সিলেট- সুনামগঞ্জের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সময় বলে জানিয়েছেন।
Leave a Reply