রাকিব হোসেনঃ লালমনিরহাট পাটগ্রাম উপজেলার কৃতিসন্তান সায়েদুল ইসলাম মিঠু। বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধা গবেষক। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার আদায়ে তিনি বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। তাঁহার ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া বর্তমান বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে একটি লিখা লিখেছেন তা খুবই সমউপযোগী। এ লিখাটির ব্যাপক প্রচার সময়ের দাবী, তাই তাঁর নিজের কথাগুলো হুবহু তুলে ধরা হলোঃ
“বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে দেশে যে তুলকালাম কাণ্ড চলছে তা আমরা টেলিভিশন পত্রিকা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিনই দেখছি। দফায় দফায় তালিকা প্রকাশ, নানারকম যাচাই বাছাই সবমিলিয়ে আয়োজনের কোন ঘাটতি নেই। দূর থেকে দেখলে মনে হবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জামুকা ফাটাফাটি কাজ করছে। কিন্তু কাছে এসে খানিকটা এপাশ ওপাশ চোখ বুলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে আসলে সব লবডংকা। কথায় আছে খালি কলসি বাজে বেশী। মুবিম আর জামুকার অবস্থাও তাই। নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের নামে মাথাভারী প্রশাসন জামুকা আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাজটি প্রতিনিয়ত আরও জটিল করে তুলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দূর থেকে আর দশজনের মতোই দেখছেন আর ভাবছেন, বাহ আমার মন্ত্রী আর তার সাঙ্গ পাঙ্গ আমলারা তো বেশ কাজের। তাই তিনি হয়তো তালিকা নিয়ে খবর শোনেন কিংবা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর বক্তব্য শুনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে ভাবেন আমার পিতার সোনার বাংলা বাস্তবায়নে আর বেশিদিন নেই। কিন্তু তিনি খেয়াল করেন না যে প্রদীপের নীচেই অন্ধকারের বাস। খেয়াল করার সুযোগও নেই, কারণ সুযোগ সন্ধানী আমলা আর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা তাঁকে সেই অন্ধকার জায়গাটা দেখতে দেন না। এরা গত বারো বছরে এরা ধীরে ধীরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর সত্যের মাঝখানে একটি অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে ফেলেছেন। যার ফলে তাঁর সদিচ্ছা থাকলেও সত্যটা তিনি সহজে জানতে পারবেন না। যদিও ক্ষমতার রদবদল হলে দুর্নীতিবাজ আমলারা নতুন সহযোগীদের নিয়ে নতুন দেয়াল নির্মাণের কাজে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েন। তখন পুরনো দেয়ালটা সহসাই সরে গিয়ে আসল এবং নিখাদ সত্যটা দৃশ্যমান হয়। কিন্তু ততদিনে দেশ ও জাতির মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যায়। গত পঞ্চাশ বছরে আমরা সাধারণ জনগণ এরকম অসংখ্য ঘটনা অবলোকন করেছি আর দূর থেকে গলা ফাটিয়ে যার পর নাই চিৎকার করেছি। কিন্তু সেই চিৎকার ক্ষমতার অদৃশ্য দেয়ালে আছড়ে পূণরায় আমাদের কাছেই ফিরে এসেছে।
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশ ছবিটা যারা দেখেছেন তারা ছবির এই সংলাপটির সাথে পরিচিত, “জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই”। আমাদের দুর্নীতিবাজ আমলা আর রাজনীতিকরা এই সংলাপটিই একটু ঘুরিয়ে ভাবেন, ” পঞ্চাশ বছর পরে আসল মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, তালিকা করার চেষ্টা বৃথা তাই”। একারণেই তারা দফায় দফায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে তালিকা প্রকাশ করছেন আর নিত্য নতুন মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছেন। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তোতা কাহিনীর রাজার মতোই দেখছেন আর ভাবছেন, এই তো আর কয়েকদিন পরেই আমার তোতার মুখে বুলি ফুটবে।
এবার আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। ডাহাগ্রাম (কাগজে কলমে দহগ্রাম) ছিটমহলের কথা আমরা সকলে জানি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে এই ছিটমহলের ভূমিকার কথা আমরা তেমন একটা জানিনা। ৭১ সালে এখানে গুটিকতক ধনাঢ্য মুসলিম পরিবার এবং সনাতন ধর্মাবলম্বী বেশ কিছু লোক বসবাস করতো। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অধিকাংশই ১৯৯২ সালের ২৬ জুনের পরে ডাহাগ্রাম ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গের অভিবাসী হয়। ৭১ সালে এই ছিটমহলে খুব বেশী হলে দু’ হাজারের মতো লোক বসবাস করতো। এই ডাহাগ্রামেই তখন তৈরি করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি ট্রানজিট ক্যাম্প। মুজিব ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগে যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক যুবকদের লাঠি হাতে লেফট রাইট করে বেশ কিছুটা সময় কাটাতে হতো। কুচবিহারের টাপুরহাটে আর জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জে এরকম আরও দুটি ট্রানজিট ক্যাম্প ছিল। সেসময় এইসব ক্যাম্পগুলোকে ইয়োথ ক্যাম্প বলা হতো। যাই হোক ডাহাগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি উমর আলী প্রধান এবং সাধারণ সম্পাদক সাবুবর রহমানের নেতৃত্বে এই ইয়োথ ক্যাম্পটি পরিচালিত হতো। লালমনিরহাটের সেকেন্দার গার্ডকে মুজিবনগর সরকার এই ক্যাম্পটির সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। ক্যাম্পটির অবস্থান ছিল বর্তমান সৈয়দপাড়া স্কুলের মাঠে। পাটগ্রাম সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অনেক যুবকই তখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য এই ট্রানজিট ক্যাম্পে এসেছিল। এবং মুল ট্রেনিং শেষ করে ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিল। তবে ডাহাগ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে মাত্র ৮ (আট) জন সনাতন ধর্মাবলম্বী যুবক সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল যাদের প্রত্যেকেরই ভারতীয় তালিকা নম্বর রয়েছে। স্থানীয় মুসলিম যুবকদের মধ্যে কেবল সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি উমর আলী প্রধানের ভাজতা আব্দুর রাজ্জাক প্রধান ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) হিসেবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া ডাহাগ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এমন কারো নাম আমার জানা নেই বা কোন তথ্য প্রমাণও নেই। তবে সেসময় ডাহাগ্রামের নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলেই ইয়োথ ক্যাম্পটি পরিচালনা করা সহ যুদ্ধের নানা কাজে জড়িত ছিলেন। যাদের মধ্যে প্রাক্তন চেয়ারম্যান তফিজুল হক সরকার এখনো আমাদের মাঝে জীবিত আছেন।
কিন্তু ডাহাগ্রামের সেই আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাঁদের পরিবারের কেউই এখন আর ডাহাগ্রাম কিংবা বাংলাদেশে বসবাস করেনা। বা সরকারি ভাতাও কেউ তোলে না। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁদের দেশপ্রেম নিশ্চিতরূপে প্রশ্নাতীত। তারপরেও তাঁরা তাদের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে চলে গেলেন কেন সেটা আলাদা প্রসঙ্গ। কিন্তু তাই বলে কী আমরা তাঁদের অবদানের কথা ভুলে যাবো? তাঁরা এখন সরকারী ভাতা তোলেন না বলে কী মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকাতেও তাঁদের নাম থাকবে না? এই প্রশ্নের কী জবাব দেবেন মুবিম আর জামুকা? এদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দায় কার?
অসংখ্য ভুলে ভরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরীক্ষা করা কিংবা দুর্নীতিবাজ আমলা আর রাজনীতিকদের রুখবার কি কেউই নেই? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি দেয়ালের ঐ পাড়েই থাকবেন? মনে রাখবেন ইতিহাস কিন্তু কাউকে ক্ষমা করেনা।”