মির্জা মাহামুদ হোসেন রন্টু নড়াইলঃ এসএম সুলতানের পালিত কন্যা নীহার বালা আট বছর ধরে চোখে দেখেন না বললেই চলে। রয়েছে শারীরিক অন্যান্য অসুস্থতা।
বরেণ্য চিত্রশিল্পী সুলতানকে দীর্ঘ দুই দশক আগলে রেখেছিলেন এই নারী। নীহারের মাতৃস্নেহে শিল্পীর বাউন্ডুলে জীবনের অবসান ঘটে। সুলতানের জীবনকে খানিকটা শৃঙ্খলার মধ্যে এনে ছবি আঁকার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন এই নারী। পরিবারের রান্না-বান্না, পারিবারিক কাজ, শিল্পীর সংগ্রহে থাকা পশু-পাখিদের খাওয়ানো ও দেখভাল করতেন তিনি। সুলতানের ঘরে যখন টাকার অভাব, রান্নাঘরে চালশূন্যতা, পশুপাখিদের খাদ্যাভাব তাকে পাগলপ্রায় করে তুলতো।
শিল্পীর অসুস্থতায়, দুর্দিনে এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে একমাত্র সেবাময়ী হয়ে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন নীহার। ৮৪ বছর বয়সের এই নারী চোখে দেখতে পাবেন সামান্য একটা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ছানি কাটলে। কিন্তু সামান্য ক’টা টাকার অভাবে তা হয়ে উঠছে না। সরকারিভাবে যে ভাতা তিনি পান তার চেয়ে ওষুধ কিনতে খরচ হয় বেশি। অসুস্থ ও অন্ধত্বের কারণে চলাফেরা করতে না পারায় বিছানায় অথবা ঘরের এক কোণে সারাক্ষণ শুয়ে-বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তিনি।
১৯৬৮ সালের দিক থেকে শিল্পী সুলতান শহরের কুরিগ্রামে জমিদারদের একটি পরিত্যক্ত দ্বিতল জরাজীর্ণ বাড়িতে (বর্তমান সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার শিশুস্বর্গ ভবন) থাকতেন। প্রতিবেশী হিসেবে নীহার বালার চানাচুর বিক্রেতা স্বামী হরিপদ সাহার সাথে শিল্পীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। সেই সুবাদে নীহার শিল্পী সুলতানকে ‘কাকু’ বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৭৫ সালের দিকে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর ছোট ছোট দুই মেয়ে নিয়ে আর্থিক অনিশ্চতায় পড়েন নীহার বালা। এ সময় শিল্পী সুলতান আমাশয়সহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন। সেই সময় রোগাক্রান্ত শিল্পীর সেবায় এগিয়ে আসেন নীহার। সেই থেকে নীহার বালা ছোট ভাই দুলাল সাহা এবং শিশু দুই কন্যা বাসনা ও পদ্মকে নিয়ে শিল্পীর বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।
১৯৯৪ সালে সুলতানের মৃত্যর পর শহরের কুরিগ্রামে শিল্পীর বাড়িতে গড়ে ওঠা ছোট চিড়িয়াখানাটির পশু-পাখি নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা চিড়িয়াখানায়। ২০০৪ সালে শিল্পীর বাড়িতে তৈরি হয় সংগ্রহশালা। এ সময় বাড়ির সৌন্দর্য রক্ষার অজুহাতে নীহার বালাকে এখান থেকে সরিয়ে সংগ্রহশালা এলাকা-সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে সরকারিভাবে দুই কামরার একটি টিনের ঘর করে দেওয়া হয়। সেখানেই জীবনযাপন করছেন শিল্পীর পালিত কন্যা।
সুলতানের শিষ্য নড়াইল সরকারি বালক বিদ্যালয়ের চিত্রাংকন বিভাগের শিক্ষক সমির বৈরাগী বলেন, চিরকুমার শিল্পী সুলতানের পারিবারিক জীবন বলতে ছিল নীহার বালা ও তার দুই মেয়েকে নিয়ে। নীহার বালা পিতৃতুল্য শিল্পীর সেবা করেছেন, তাকে শাসন করেছেন, ছবি আঁকায় উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং পারিবারিক সমস্ত কাজ দেখাশোনা করেছেন। শিল্পীর খ্যাতিমান হওয়ার পেছনে নীহার বালার বড় ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
নীহার বালা সাহার নাতি সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার অফিস সহায়ক নয়ন সাহা বলেন, ‘দিদা সরকার থেকে ভাতা পান পাঁচ হাজার টাকা। আমি সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা থেকে পাই চার হাজার। স্ত্রী-পুত্র ও দিদাকে নিয়ে চারজনের সংসার। শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের জন্য প্রতি মাসে ওষুধের পেছনে খরচ হয় সাড়ে ছয় হাজার টাকার মতো।’
তিনি জানান, কয়েকবার নীহার বালা অসুস্থ হলে নড়াইল সদর ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসার জন্য নীহারকে প্রথমে প্রতিবছর ৩৫ হাজার পওে, দু’বার ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয় সরকারিভাবি। ২০১৪ সাল থেকে তা বন্ধ রয়েছে। সবশেষ ২০১৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে গুণী মানুষ হিসেবে এক লাখ টাকা অনুদান পেয়েছিলেন নীহার।
রোগশয্যায় শুয়ে নীহার বালা বলেন, ‘সুলতানের শিশুস্বর্গ বেঁচে থাকুক। সুলতানের স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন হোক- এটাই আমি চাই। আমার জীবনের শেষ দাবি, আমি যে বাড়িতে বসবাস করছি সেটি আমার নামে লিখে দেওয়া হোক।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘তার (নীহার) অসুস্থতার বিষয়টি শুনেছি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ডিজি মহোদয়ের সাথে কথা হয়েছে। আগামী ১০ অক্টোবর শিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যাপারে কী করা যায় তা নিয়ে কথা বলবো।’
বরেণ্য চিত্রশিল্পী সুলতান ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট শহরের মাছিমদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর তিনি মারা যান। রোববার (১০ অক্টোবর) এই শিল্পীর ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হবে।