আজ ১১ ই আগস্ট বুধবার পবিত্র মহররম মাস শুরু হয়েছে । মহররম আরবি শব্দ এর মূল ধাতু হুরূম বা হারাম, এর দুই অর্থ ১.মর্যাদাপূর্ণ , সম্মানিত ২. নিষিদ্ধ।
এই মাস মর্যাদাপূর্ণ ,সম্মানিত এই কারণে যে মহান আল্লাহর কাছে এই মাস অত্যন্ত সম্মানিত, মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বার’টি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। (যার মধ্যে রয়েছে মহররম মাস) -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬
হারাম শব্দের অন্য আরেকটি অর্থ নিষিদ্ধ ,
অর্থাৎ এই মাসে কোন ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ-বিগ্রহ করা হারাম নাজায়েজ ও নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে মাসটিকে পাক ও মুক্ত বলে পবিত্র ও সম্মানিত মাস বলা হয় ।
আর এই মাসের ১০ তারিখে আগামী ২০ আগস্ট শুক্রবার পালিত হবে পবিত্র আশুরা ।
আর রমজানের পরে রোজার জন্য মর্যাদাপূর্ণ মাস হল আল্লাহর মাস অর্থাৎ মহররম মাস।
এই কারণে সম্মানিত সেই চার মাস সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছে, আসমান-যমীনের সৃষ্টির সময় যেমন ছিল। (কারণ, জাহেলী যুগে আরবরা নিজেদের স্বার্থ ও মর্জিমত মাস-বছরের হিসাব কম-বেশি ও আগপিছ করে রেখেছিল।) বার মাসে এক বছর । এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- যিলকদ, যিলহজ্ব ও মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৬২
মুহাররমের তাৎপর্যের কথা শুধু এতটুকুতেই শেষ নয় যে, মহান আল্লাহ যে চারটি মাস কে সম্মানিত বলেছেন মুহাররম তার অন্তর্ভূক্ত। বরং অপর এক হাদিসে মুহাররমকে “শাহরুল্লাহ” বা আল্লাহর মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সহিহ মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় প্রিয় নবীজি সা. বলেন, ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮
অপর এক বর্ণনা মতে, হযরত আলী রা.কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’-জামে তিরমিযী ১/১৫৭
এই মাসের প্রতিটি দিনই সম্মানিত ও তাৎপর্যপূর্ণ তবে মুহাররমের দশম তারিখ বা আশুরার দিন কিছু বিশেষ বৈশিষ্টের দরুন অনন্য। যেমন এই দিনের রোজা সম্পর্কে সহিহ হাদিসে এসেছে- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ সহীহ বুখারী ১/২১৮
অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭
তবে এই দিনটিকে যেহেতু ইয়াহুদিরা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ মনে করে রোজা রাখে সেহেতু প্রিয় নবীজি সা. আমাদের এই দিনের রোজার সাথে আরো একটি রোজা রেখে মোট দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে বিজাতীয়দের সাদৃশ্যতা না হয়। নবীজি সা. বলেন- আশুরার রোযা সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’ মুসনাদে আহমদ ১/২৪১
এ মাসের সাথে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পৃক্ত। যা এই মাসকে অন্যান্য মাসের থেকে আরো বেশি স্মরণীয় করে তুলেছে। এদিনে আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১
তবে এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন হযরত ইউসুফ আ. জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইয়াকুব আ. চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। হযরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস আ.কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে বলে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই।-আল আসারুল মারফূআ, আবদুল হাই লাখনেবী ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ ২৫৩-২৫৭।
এ মাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনার অন্যতম একটি হলো রসুল দৌহিত্র হুসাইন রা. এর শাহাদাৎ। বলাবাহুল্য যে, আমাদের জন্য তা অত্যন্ত বিরহকাতর ও হৃদয়স্পর্শী ব্যাপার। তবে আমাদের চোখ অশ্রুসজল হবে, হৃদয় হতে পারে ব্যথিত, কিন্তু আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করবো না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।
অতএব শাহাদাতে হুসাইন রা.কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। অনেকে আবার শোক প্রকাশার্থে এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকে। বলাবাহুল্য এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার। সুতরাং তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।
লেখকঃ
হাফেজ মাওলানা মুফতি আশরাফুল ইসলাম, মুফাসসিরে কোরআন ,খুলনা।
Leave a Reply