লেখক,
মিজানুর রহমান মিজান:
মানুষ সৌন্দর্য পিপাসু এবং চিত্তের বিত্তশালী হতে বিভিন্ন প্রকার কর্মকান্ড পরিচালনা করে। আনন্দ ও সৌন্দর্য পরস্পর সম্পর্কিত। আনন্দ উপভোগ করার সাথে জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃতি লাভ করে। তাই আনন্দ উপভোগের বিভিন্ন প্রকার উপকরণ দ্বারা আনন্দ প্রাপ্তির প্রচেষ্টা থাকে অব্যাহত। মানুষের রুচির সাথে বিনোদনও পরিবর্তিত হয়ে থাকে। আজ যা সর্বাধিক জনপ্রিয়, কালের চাকায় আবর্তিত হয়ে নিত্য নুতন আনন্দের উপকরণ সংগ্রহে তা বদলে ফেলে বা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শুধু মাত্র স্মৃতি পরায়নতার এ্যালবামে দৃশ্য হয়, জাগরিত থাকে, ভাবনার দ্বার উম্মুক্ত করে একাকী রোমন্থনে ফিরে যায় সোনালী অতীতে।বলছিলাম শিশু-কিশোর ও যুব সম্প্রদায় এক সময় বিনোদনের হাতিয়ার রুপে গণ্যে নীলাকাশের বুকে উড়াতো ঘুড়ি।মনের আনন্দে আর সৌন্দর্যবোধের অপূর্ব আকর্ষণে হতো উদ্বেলিত। প্রেক্ষাপটে আজ গ্রাম বাংলার মাঠ-ঘাট ফাঁকা ধূ ধূ বালুচর।
গ্রাম প্রধান বাংলার আকাশ-বাতাস হত মুখরিত নবান্নের পর পরই শুরু হত ঘুড়ি উড়ানো।গ্রামের মানুষ অগ্রহায়ণ মাসে ক্ষেতের ধান উত্তোলন করে প্রায় চৈত্র মাস পর্যন্ত অবসর জীবন যাপন ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। স্বভাবতই মানুষ পরিশ্রমের পর ক্লান্তি দুরীকরণে, অবসর সময় অতিবাহিত করার মানসে নিমগ্ন থাকতো বিনোদন প্রাপ্তির প্রত্যাশায়। বিনোদনের তখনকার একটি প্রধান হাতিয়ার ছিল ঘুড়ি উড়ানো। গ্রামের মাঠে দলবেঁধে প্রতিযোগিতা হত ঘুড়ি উড়ানোর। সে মুহুর্তগুলি কত আনন্দ উচ্ছ্বাসের তা অনেকটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শুধু মাত্র অনুভব আর অনুভুতিতেই জন্ম লাভ সম্ভব। একান্ত নিজস্ব অনুভুতির অন্তর্ভুক্ত।
ঘুড়ি ছিল কয়েক প্রকার। যেমন চিলা ঘুড়ি, সাপ ঘুড়ি, বাক্স ঘুড়ি ইত্যাদি।চিলা ঘুড়ির প্রচলন ছিল সর্বত্র।যে কেহ ঐ ঘুড়ি উড়াতে সহজ সাধ্যতাবোধ করতেন। অনেকে স্বল্প সুতার দ্বারা ঘুড়ি উড়াতেন এবং ছোট শিশুদের কম সুতার সাহায্যে উড়ানোর ব্যবস্থা করে দিতেন। শিশুদের অপেক্ষাকৃত বড় তথা কিশোর যুবকরা উড়াতেন অনেক সুতার নাটাই তৈরীর মাধ্যমে ঘুড়ি। ঘুড়ির নাটাই এ যে সুতা ব্যবহৃত হততাতে প্রয়োগ করা হত বিশেষ কৌশল। কৌশলটি ছিল খালি কাঁচের বোতল বা পরিত্যক্ত ভাঙ্গা গ্লাসকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে গমের সাহায্যে সুতায় হত লাগানো। গ্লাসের বিচূর্ণ অংশ লাগানো সুতার নাটাই দ্বারা উড়ন্ত ঘুড়ি অপর ঘুড়িকে কৌশলে নাটাইয়ে লাগিয়ে টান দিলে নাটাই কেটে বা ছিড়ে গিয়ে ঘুড়ি হত পতিত। অনেক সময় কেটে যাওয়া ঘুড়ি অনেক দুর চলে যেত মালিকের নাগালের বাইরে। মালিক ঐ ঘুড়ির আশা ছেড়ে, পরিত্যাগ করে আবারো নুতন ঘুড়ি তৈরীর কাজে হত ব্যস্ত। উন্নত ঘুড়ি এবং নাটাই তৈরী করে পরাজিত হবার দুর্নাম ঘুচানোর চিন্তা-চেতনা থাকত মন ও মননে। হত তৈরী একের পর এক ঘুড়ি প্রস্তুত বা ক্রয়ের। অনেক সময় সুতা কাটা ঘুড়ি আটকা পড়ত উঁচু কোন গাছের ডালে বা বাঁশ ঝাড়ের সর্বোচ্চতে। থাকত অনেক দিন ঝুলন্ত অবস্তায়। যা দেখে ঘুড়ির মালিক আপসোস করতেন দীর্ঘদিন পর্যন্ত।অনেকে মালিককে উপহাসের পাত্র বানিয়ে করতেন হাসি তামাসা।অবশেষে একদিন বৃষ্টি বা ঝড়ের কবলে পড়ে হত নিশ্চিহ্ন। চিলা ঘুড়ি তৈরীতে ছোট ছোট বাঁশের মাত্র দুটি শলাকা এবং প্রয়োজন ছিল রঙ্গিন কাগজের। সাপ ঘুড়িতে শলাকার পরিমাণ যেমন ছিল বেশি, তেমনি শলাকা হত অপেক্ষাকৃত লম্বা। কাগজের পরিমাণ ও হত অধিক। অনেক লম্বা সাপের আকৃতি পূর্ণ বলে সাপ ঘুড়ি নামকরণ ছিল প্রসিদ্ধ। সাপ ঘুড়ি উড়াতেন সাধারণত চিলা ঘুড়ির সৌখিনদার থেকে অধিক সৌখিন ও সৌন্দর্য পিপাসুরা।উহার নাটাই সাধারণত নৌকা টানার গুণ দ্বারা হত পরিচালিত। ঐ ঘুড়ি আকাশে উড়ন্ত অবস্তায় এক প্রকার শব্দ হত যা ছিল আকর্ষিক। ঘুড়ির মালিকসহ দর্শকরা হতেন তম্ময়াচ্ছন্ন।বাক্স ঘুড়ি বাক্সের অনুরুপ বলে এ নামে ছিল অভিহিত বা পরিচিত।সে জাতীয় ঘুড়ি উড়াতেন শক্ত সামর্থ্য যুবক শ্রেণি এবং ব্যয়বহুল হেতু উচ্চাভিলাসীরাই আনন্দের উৎস রুপে গণ্য করতেন।
ঘুড়ি নিয়ে অনেক মজাদার ও রসালো কাহিনী, উপাখ্যান ছিল বিরাজমান। অনেকে হতেন মর্মাহত ছিড়ে যাওয়ায় বা প্রতিযোগিতায় পরাজয় বরণ এর দুর্নামের অংশীদার হয়ে। কার্তিক মাসে মাঝে মাঝে আকাশে ঘুড়ি দৃষ্ট হলেও পৌষের শীতল ও মৃদু মন্দ বাতাসে দেখা যেত ঘুড়ির সংখ্যাধিক্যতা। ভারী ঘুড়ির সহিত থাকত ঘুংঘুর সংযুক্ত। উহার রিনিঝিনি শব্দ মনে লাগাতো দুল, হৃদয়ে জাগাতো স্পন্দন। অনেকে ঘুড়ি তৈরী করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে সাংসারিক আয়ের উৎস রুপে করতেন ব্যবসা।বাজারে পাওয়া যেত প্রচুর পরিমাণে। আজ ঘুড়ির সাথে বর্তমান প্রজন্ম অজ্ঞাত, অজানা, অচেনা থেকেই যাচ্ছে। কারন ঘুড়ি উড়ানোর সংস্কৃতি উধাও হয়েছে বদলের আবহাওয়ায়। ঘুড়ি নিয়ে অনেক উপাখ্যান রয়েছে বয়োজৈষ্টদের স্মৃতির জানালায়।হয়েছে রচিত অনেক কবিতা, গান আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনার বহি:প্রকাশ রুপে। যেমন-ঘুড্ডি দিয়াছে উড়াই, হাতে রাখিয়া নাটাই, বেলাশেষে আনে সুতা টানি।