মুহাম্মদ সায়েস্তা মিয়া (ছোট গল্প)
একটু সুখের উল্লাসে মন পবনের নৌকায় অজানার উদ্দেশ্যে রাত এগারোটায় শিরি মোহনের হাত ধরে ঘরের বাহিরে এলো। সন্ধ্যা থেকে মোহন শিরির জন্য বাড়ির বাহিরে অপেক্ষায় আছে আর একটু পর পরই শিরিকে এস এম এস করছে এতো দেরি হচ্ছে কেন ? রাতের খাবার খেয়ে সবাই যখন যার যার বিছানায় শুয়েছে তখন উপযুক্ত সময় সুযোগ বুঝে শিরি মোহনকে এস এম এস করে বলল তুমি দক্ষিণের হিজল গাছের পাশে থাকো আমি এক্ষুণি আসছি। (অজপাড়াগাঁয়ের সাধারণ অবলা নারীর সরল সহজ প্রেমের পরিণাম কি হয় সে জানে না, জানে না যেমন আরো অনেক মেয়েরা) শিরি পরনের সেলোয়ার কামিজ আর নিজের গহনাপত্র নিয়ে আস্তে করে ঘরের দরজা খুলে ঘরের বাহিরে পা দিয়ে পিছন তাকালো না। পূর্ব কথামত মোহনকে যথাস্থানে পেয়ে শিরি তার হাত ধরে সুরমা নদীর পাড় ঘেঁষে অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটছে। অনেক দূর পথ যেতে যেতেই ক্লান্ত দেহে একটু বিশ্রামের আশায় দুজন আঁধারে বসে পড়লো। শিরির পা আর চলছে না। মোহন শিরিকে তার সামনে বসিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো শিরি আমরা অনেক দূর এসে গেছি ভোর হবার আগেই বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছে যাবো। শিরি প্রশ্ন কেন? তোমার বাড়িতে যাবে না। না, তোমাকে নিয়ে বাড়ি গেলে কেউ মেনে নিবে না। তাই আজ থেকে খোলা আকাশের নিচে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে এ পথেই পা দিয়েছি। শিরি যতটুকু অবাক হলো তার চেয়ে বেশি চিন্তায় মনে দিলো হানা। ভাবছে কি করলাম, এভাবে চলে আসাটা কি ঠিক করেছি? মনের ইচ্ছা পূরণ আর ভালোবাসতে গিয়ে একটি বার মা বাবার কথাটাই খেয়াল করিনি। কাল সকালে আমাকে না পেয়ে না জানি মা বাবার কি অবস্থা হয়। শিরি পরিবারের বড় মেয়ে তার আরো ছোট দুটি বোন আছে। সে সবেমাত্র মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। বড় সন্তানের জন্য বাবা মায়ের যতো স্নেহ ভালোবাসা থাকে তার কোন কমতি কখনো শিরির বেলায় হয়নি। শিরি একবারও ভাবেনি তার ছোট দুটি বোনের ভবিষ্যতের কথা। আমাদের সমাজে কেউ কারো হাত ধরে চলে গেলে পরিবারকে সামাজিক অপবাদের অপমানের বোঝা অনেক যুগ অনেক কাল অন্য সদস্যরা বহন করে বেঁচে থাকতে হয়, থাকতে হয় একঘরি একপরিবারে ও আত্মীয়তা বা প্রতিবেশী সমাজ থেকে একা ও আলাদা। বংশ ও আভিজাত্যের খাতায় কালিমা লেপনে পরিবারের অন্য সদস্যদের অনেক নির্যাতন অপবাদ সইতে হয়। এ নির্যাতন কখনো কোন পরিবার আশা করে না। পরিবারকে এমন অসহায়ত্বে ফেলা মোটেই উচিত নয় এবং যারা এমন কাজ করে তাদের একটু ভাবা উচিত। হঠাৎ মোহন লক্ষ্য করলো শিরি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। শিরির দৃষ্টি আকর্ষণ করে নীরবতার কারণ জানতে চাইলে শিরি কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো। কিছু সময় অতিবাহিত হলে শিরি জানতে চাইলো আমরা কোথায় যাচ্ছি? মোহন: বললাম তো দু-চোখ যেখানে যায় সেখানে। মোহন: এবার উঠো রাত শেষ হয়ে আসছে যেতে হবে। শিরি আবারও বলল কোথায় যাব? মোহন: শহরের কোথাও চলে যাবো। তখন রাত দুইটা বাজে, দু-জন আবার হাঁটতে শুরু করল। এবারও অনেক পথ হেঁটে দুজন বসে পড়ে। খুব কাছাকাছি বসলো দুজন। মোহনের যৌবনের দরজার বাঁধ ভেঙ্গে গেলে হারাতে চাইলো শিরিকে নিয়ে অজানায়। শিরির বুকে তার বুক লাগিয়ে একটু জোরে আটকিয়ে ধরলো শিরিকে। শিরি সর্ব শক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলে মোহন বলল শিরি এমন করছো কেন? আমার ইচ্ছাটা পূরণ করতে দাও। শিরি: হ্যাঁ দেব তবে বিয়ের পরে এখন নয়। দুজনে হলো কথা কাটাকাটি জোরাজোরি। শেষ পর্যন্ত শিরি বলল এই তোমাকে ভালোবাসার ফল, আমার সর্বনাশ করতে চাও? মোহন: সর্বনাশ কিসের, এখানে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ কি আছে, কদিন পরে তো বিয়ে করবই। তাই যদি হয় বিয়ে পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। আমি তোমার সাথে কোন নাফরমানী কাজ করব না করতে দেবনা। যদি তোমার প্রেম খাঁটি হয় সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করো না হয় আমাকে আমার বাড়ি পৌঁছে দাও। নোংরামীর নাম ভালোবাসা নয়, ভালোবাসা হলো পবিত্র, সুখের বন্ধন, জীবন চলার সহযোগী। তুমি এমন জানলে আমি তোমার হাত ধরে বের হতাম না। মোহন: হাত যখন ধরেছো আমি যা চাই তা মেনে নাও না হলে ভাল হবে না। শিরি: তুমি কি করবে ? আমাকে নষ্ট করবে? করো তবে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে করবে, শুধু দেহ পাবে মন পাবে না। মোহন: মন পাবার দরকার নেই আমি দেহই চাই এসো শিরি এসো। মোহন শিরিকে ঝাপটিয়ে ধরে পাঁজাকুলো করে সর্বনাশের আশায় এক পর্যায়ে মাটিতে শুইয়ে দিলে শিরি কোন উপায় দেখছে না কি করলে মান জীবন দুটোই বাঁচবে।
ধস্তাধস্তির ফাঁকে এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে শিরি মোহনের চোখে সজোরে ঘষালো, তাতেই মোহন শিরিকে ছেড়ে চোখ বাঁচাতে ব্যস্ত হলে শিরি অন্ধকারে দৌড়ে পালাতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে কোথায় যাচ্ছে কিছুই জানে না। অনেক পথ অন্ধকারে পিছন দিকে দৌড়ালো। বাড়ির পথ টের করতে পারছে না শুধু প্রাণপণে ছুটে চলা। আবার মেয়েদের দৌড় বলে কথা। গভীর রাত নির্জন নিস্তব্ধতা আর হঠাৎ শিয়ালের হুক্কা হুয়া দিল কাঁপানো ডাক, ভয়ে শিরির গলা শুকিয়ে গেছে। আর না পেরে বসে পড়লো, জঙ্গলের পাশে। এটা একটা বাড়ি, কিন্তু সে জঙ্গল মনে করছে। কি জানি কি হয় ভয়ে থরথর করে কাঁপছে শিরি। মনকে শক্ত করে ভুলের মাশুল গুণতে ভাবছে সে, সুখের হিসাব কষতে অনেক অঘটনের জন্ম হয় এভাবে। কতো নারী যে এভাবে অসহায় হয় কে জানে। এখন কোন মুখে বাড়ি ফিরে যাই কাকে কি বলে যে বিশ্বাস করাবো পথ নেই। মনে মনে অনেক দোয়া দুরুদ পড়ছে আর প্রভাতের অপেক্ষা করছে কখন সূর্যোদয় হবে। বিপদে রাত ফুরায় না যেন অনেক বেশি লম্বা। দেখতে দেখতে মসজিদের মিনারে মুয়াজ্জিনের আযান ধ্বনি উচ্চারিত হলো (আল্লাহু আকবার)। শিরি মনে মনে তওবা করছে আল্লাহর নিকট আমার এ চরম ভুল ক্ষমা করো মাবুদ। আমাকে সাহায্য করো, আমি ভুল করেছি রাতের আঁধারে পরপুরুষের হাত ধরে। তুমি ইজ্জতের মালিক, সবাই জানার আগে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও। মনে মনে কথা বলছে আর ভাবছে কোথায় আছি এখন আমি। চতুর্দিকে আযানের মুহুর্মুহু কলতান ভোরের পাখির মিষ্টি কলরব, দোয়েলের শিষ, পূর্ব আকাশে প্রভাতের আভা জাগছে। এমন সময় শিরির কয়েক শত গজ দূর থেকে উচ্চারিত হলো মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ফজরের নামাজের আযান। অদ্ভুত ব্যাপার এ যে চির চেনা পরিচিত কণ্ঠস্বর তাদেই গ্রামের মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ এটা, এটা যে তাদেরই গ্রাম। আল-াহর শুকরিয়া আদায় করে দিক নির্ণয় করে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। মুসলি-রা নামাজের জন্য আসছে আর শিরি সবার অলক্ষ্যে পূর্ব পাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পূর্ব আকাশে সূর্য্যরে লাল আভা উদয়ের জানান দিচ্ছে। মাত্র দুই মিনিটে শিরি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।
ভাবলো কেউ যেন না দেখে। ঠিক তাই করতে গিয়ে যখন ঘরের দরজায় গেল তখন মাথায় বজ্রপাত, তার মা (শিরির মা) অঝোর ধারায় চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছেন। শিরি মাকে কিছু বলার আগেই তার পায়ে পড়ে বলল মা তোমার দোহাই লাগে আমাকে মাফ করো, আমি ভুল করেছি। আমি ভাল আছি কোন ক্ষতি হয়নি। সব খুলে বললো শিরি। শিরি: মা, বাবা জানতে পেরেছে। না জানেনি। তুমি কিভাবে জানলে শিরির প্রশ্ন। আমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা তুই নেই। সেই থেকে যা বুঝার বুঝে আমি এখানে বসে কাঁদছিলাম। শিরি: মা, একমাত্র মোহন আর তুমি ছাড়া কেউ জানেনি এখন ঘরে চলো আর কাউকে বুঝতে দিও না ভোর বেলায় আমি ফিরে আসার কারণ।
সমাপ্ত