মোঃ আব্দুৃল কাইয়ুমঃ
অতীতে বিবাহকার্যে ব্যবহৃত হতো এই পালকি। বেহারাদের কাঁধে বহনকারী পালকিতে চড়েই বর গমন করত কনের পিত্রালয়ে। আর পালকির সঙ্গে আসত পদব্রজে বরযাত্রীরা। তা ছাড়া রাস্তায় বেহারাদের মুখের হু হু না না, পালকি চলে রে সহ অসংখ্য গানের শব্দে ছুটে আসতো প্রতিবেশী ছেলেমেয়েরা।
ধর্মীয় বিধিবিধান ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন হলে অনুরূপভাবে পালকিতে উঠে বসত নববিবাহিতা স্বামী-স্ত্রী। অন্ধ বিশ্বাসকে সামনে রেখে নববিবাহিত স্ত্রীর সাথে দেয়া হত রসুন, হলুদ, কালিজিরা ইত্যাদি বেঁধে দেওয়া হতো। যাতে ভূত, প্রেত বা জিনের আছর না লাগে। এ সময় ব্যতিক্রমধর্মী আনন্দ,ফুর্তি থাকত মুরব্বিদের পাশাপাশি ছোটদেরও।
পালকির ইতিহাসঃ ধারণা করা হয় প্রাচীনকালে দেব-দেবীকে আরোহন বা, দেব-দেবীর মূর্তি বহনের জন্য পালকি সাদৃশ্য বাহন ব্যবহার করা হতো। অনেক প্রাচীন মন্দিরেই পালকি দিয়ে দেবতাদের বহনের দৃশ্য ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুদের রামায়নেও আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০ সালের সময়ের দিকে পালকির উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইউরোপের উচ্চ শ্রেণীর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এই পালকিতে চলাচল করতেন। কিন্তু,উপমহাদেশে রেলগাড়ি প্রচলেন পর ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মাঝে পালকির ব্যবহার অনেকটাই কমে আসে।
পালকির ধরণঃপালকি সচরাচর তিন ধরনের হয়ে থাকে; যেমন—সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি আয়তাকার। চারদিক কাঠ দিয়ে আবৃত এবং ছাদ ঢালু। এর দুই দিকে দুটি দরজা থাকে। কোনো কোনোটিতে জানালাও থাকে। পালকির বাইরের দিকে আলপনা আঁকা থাকে। আয়না পালকিতে আয়না লাগানো থাকে। ভেতরে চেয়ারের মতো দুটি আসন ও একটি টেবিল থাকে। ময়ূরপঙ্খি পালকির আয়তন সবচেয়ে বড়। এই পালকি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়। ভেতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল ও তাক থাকে। এই পালকির বাঁটটি বাঁকানো এবং এর বাইরের দিকে কাঠের তৈরি পাখি, পুতুল ও লতাপাতার নকশা থাকে।
বাংলাদেশের পালকিগুলো বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। এর গঠন শৈলীতেও রয়েছে ভিন্নতা। সবচেয়ে ছোট এবং সাধারণ নকশার পালকিকে ডুলি বলা হয়। এই ডুলি সাধারণত ২ জন বহন করে নিয়ে চলে। বাংলাদেশে এক সময় হাড়ি, মাল, দুলে, বাগদি বা, উড়ি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক পালকি বহনের কাজ করতো। এরা পালকি বহনের পাশাপাশি দিনমজুরের কাজ এবং মাছের ব্যবসাও করতো।
কাঠ মিস্ত্রীরা সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ, গান কাঠ প্রভৃতি কাঠ দিয়ে তৈরি করতো পালকি। পালকির বহন করার দন্ডটিকে বাঁট বলে। এই বাঁট তৈরি হত বট গাছের বড় ঝুরি দিয়ে।
তাইতো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘পালকি চলে গগন তলে…। আর ভুপেন হাজারিকার গাওয়া ‘দোলা ও দোলা… বড় বড় মানুষের দোলা।’ আজও সেসব স্মৃতিসচেতন মানুষকে নাড়া দেয়।
বাংলাদেশে এক সময় অভিজাত শ্রেণীরা এই বাহনে চলাচল করতো। দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানেও এর ভালই প্রচলন ছিল। এছাড়াও অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে বা, অক্ষম মানুষকে বিভিন্ন স্থানে নেয়ার জন্যও পালকি ব্যবহার হতো।
যোগাযোগব্যবস্থার ক্রমাগত প্রসার, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যানের চলাচল এবং পেডালচালিত রিকশা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
সেদিনের সেই বর-কনে বহনকারী পালকির স্থান দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন বিদেশি উন্নত মানের গাড়ি,রিকশা, বাসসহ আধুনিক সব যানবাহন। সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের খাদ্যসামগ্রীতেও পরিবর্তন এসেছে। ঘ্যাগা নাশতার পরিবর্তে এসেছে,রোস্ট, পোলাও, কোরমাসহ উন্নত এবং আধুনিক খাদ্যসামগ্রী। আর খাবার পর হাত পরিষ্কার করার জন্য বেঁধে রাখা গামছার পরিবর্তে এসেছে টিস্যু পেপার।
নতুন প্রজন্মের কাছে পালকি যেন এখন রুপকথার গল্প।বর্তমানে পালকি বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই পরিচিত।