মো নাহিদ হাসান নওগাঁঃ
যতদূর দু’চোখের নোঙর, কেবলই মাঠভরা সোনা ধান। ধানই ছিল চাষির ধ্যানজ্ঞান। এখন বরেন্দ্রর বুকে শুধু ধান নয়, আমও ফলে। ধানের চেয়ে আমে লাভ- এই আওয়াজটা চাষির কানে গেলে ২০০৭ সালে হঠাৎ নওগাঁজুড়ে শুরু হয় ধুন্ধুমার আমের আবাদ। অনেক ধানপ্রেমী চাষি মজেন আম ফলানোর নেশায়। একটা সময় নওগাঁ চেনা ছিল ধানের স্বর্ণভূমি হিসেবে। এখন ধানের মাঠে, আনাচেকানাচে দোলে আম। এই পটভূমিতে মুহূর্তেই বদল বরেন্দ্রর চেনা মঞ্চ। চাষিদের আবাদের নেশার ওপর ভর করে নওগাঁর আম বিপ্লবের পালে বইছে শুভবার্তার হাওয়া। এ মৌসুমেই প্রধান দুই আম উৎপাদনকারী জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জকে টপকে দেশের সবচেয়ে বড় বাজারের খেতাব নিতে চলেছে নওগাঁ। চাষি ও ব্যবসায়ীদের আশা, এবার দুই হাজার কোটি টাকার আম বেচাকেনা হবে শুধু নওগাঁতেই।
গত তিন মাসে দেশের বেকার সংখ্যা তিন লক্ষ ছাড়িয়েছে। ঠিক সেই সময় তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা নওগাঁর সাইদুলতলী বাজারের কাউসার আহম্মেদ নানা ধরনের ফল উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।করোনাকালীন সময়ে বিশ্বে যখন স্থবিরতা বিরাজ করছিল ঠিক সেই মুহূর্তে অবসর সময়টাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় ভাবছিলেন তিনি। তার আগেই ক্ষুদ্র ভাবে শুরু করেছিলেন মালটা আর আম চাষ।
যা বর্তমান প্রায় ১১ বিঘা ফসলি জমিতে চাষ করছেন তিনি । এই বছর সবকটি আম গাছেই এসেছে গাছ ভর্তি আম । ১২ মাসই কাউসার আহম্মেদের বাগানে থাকে আম। আমের পাশাপাশি কাউসার আহম্মেদের বাগানে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার মালটা, কুল সহ সিজনারি ফল ফলাদি। ৪ বছর আগে কাউসার আহম্মেদ ভারত এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসেন এইসব গাছের চারা। এরপরে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে করেছেন প্রতিষ্ঠিত। ১২ মাসেই তার ফল বাগানে কোন না কোন ফল থাকেই । কাউসার আহম্মেদ জানালেন, তাঁর ইচ্ছা-শক্তির জন্যই এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন তিনি। মূলত শখের বসে করেছিলেন বাগান।পরবর্তীতে সেই বাগানেই পেয়েছেন সফলতা ,হয়েছেন উদ্যোক্তা। ছোট থেকেই কিছু করা আক্ষেপ থেকেই একজন সফল ব্যক্তি কাউসার আহম্মেদ। বাগানের পাশাপাশি রয়েছে তার নিজস্ব একটি ইলেকট্রনিক পন্যের শোরুম। কাউসার আহম্মে বলেন, বরেন্দ্র এলাকায় মাটির বৈশিষ্ট্যের কারণেই প্রচুর ফলন হয় আমের। জেলায় এখন বছরজুড়েই আমের চারা বিক্রি হয়। নতুন মাটি ও নতুন গাছ হওয়ার কারণে দিন দিন ফলন বাড়ছে। নওগাঁয় এক বিঘা জমিতে ধান আবাদ করে এক মৌসুমে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হতে পারে। বিপরীতে সমপরিমাণ জমির আমবাগানে আয় ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পাওয়া যাবে।
এখানে আমের কোনো সংরক্ষণাগার নেই। জুনের মাঝামাঝি সময়ে আম্রপালি বাজারে নামে, তখন চাষিরা ভালো দাম পান না। জুলাইয়ের শেষে বাজারে আমের দাম অনেক বেশি হয়। এক-দেড় মাস আম সংরক্ষণ করা গেলে চাষিরা লাভবান হতে পারতেন বেশি।
এ বছর সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয়েছে নওগাঁর পোরশায়। জমির পরিমাণ ১০ হাজার ৫২০ হেক্টর। এ ছাড়া সাপাহারে ১০ হাজার হেক্টর ও পত্নীতলায় ৪ হাজার ৮৩৫ হেক্টর। জেলার ১১ উপজেলার মধ্যে সদরে ৪৪৫ হেক্টর, রানীনগরে ১১০ হেক্টর, আত্রাইয়ে ১২০ হেক্টর, বদলগাছী ৫২৫ হেক্টর, মহাদেবপুর ৬৮০ হেক্টর, ধামইরহাট ৬১৫ হেক্টর, মান্দায় ৪০০ হেক্টর এবং নিয়ামতপুরে ১১৩৫ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে।
কৃষি অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁয় এই মৌসুমে আমের আবাদ হয়েছে অন্তত ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে আম্রপালি ৭৬ শতাংশ, বারি-৪ আম ৬ শতাংশ, আশ্বিনা ৭ শতাংশ, ফজলি ৩ শতাংশ, ল্যাংড়া ৩ শতাংশ, ক্ষীরশাপাতি ২ শতাংশ, গৌড়মতি ১ শতাংশ, কাটিমন ১ শতাংশ এবং অন্য জাতের ১ শতাংশ জমিতে আমবাগান করেছেন চাষিরা। ভিনদেশি জাতের আম চাষেও পিছিয়ে নেই নওগাঁ। এখানে বিভিন্ন বাগানে বিদেশি আমের জাত অস্টিন, মিয়াজাকি, রেড এমপেরর, রেড আইভরি, কেনসিংটন প্রাইড, রেড পালমার, কেইট, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, আনোয়ার রাতুল, কোহিতুর, কিউজাই, ব্ল্যাক স্টোন, ফোর কেজি, কেন্ট, আপেল ম্যাঙ্গো, ব্রুনাই কিং, কারাবাউ, নাম ডকমাই, থ্রিটেস্ট, আরটুইটু, হানিডিউ, চোষা, রুবি ও কাটিমনের চাষ হয়।
এবার বিশ্বের আটটি দেশে রপ্তানি হবে নওগাঁর আম। দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সুইডেন, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান। এসব দেশ থেকে এরই মধ্যে মিলেছে ১০০ টন আমের চাহিদাপত্র।